জাতীয় পরিচয়, মূল্যবোধ ও পাঠ্যক্রম

ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ
    সময় : রবিবার, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪, ৩:০৫ পূর্বাহ্ণ
  • ১৩১ Time View

যেকোনো মানুষের পরিচয়ের দুটো প্রধান দিক থাকে, ব্যক্তি পরিচয় এবং সামাজিক পরিচয়। ব্যক্তি পরিচয়ের রকমফের থাকতে পারে। ‘রোল থিওরি’ বা ভূমিকা তত্ত্ব বলছে, এটা গড়ে ওঠে কোন মানুষ তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে কি ভূমিকা পালন করছেন তার ওপর ভিত্তি করে। যেমন, কোনো ব্যক্তি একইসাথে একজন পিতা, স্বামী, প্রকৌশলী, পরিবেশবাদী, ফুটবলার, রন্ধনশিল্পী, গায়ক, লেখক অথবা এ ধরনের একাধিক ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং একাধিক পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেন। ব্যক্তি পরিচয় পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে কোনো ব্যক্তি তার পুরনো ভূমিকা বা পরিচয় ছেঁটে ফেলতে পারেন; আবার নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নতুন পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারেন।

অন্যদিকে সামাজিক পরিচয় ব্যক্তি পরিচয়ের মতো অস্থায়ী নয়। কোনো একটি ভৌগোলিক অবস্থানে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করে ভূমি, জলবায়ু এবং পরিবেশের সাথে দীর্ঘ মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় গড়ে ওঠে এবং স্থায়িত্ব পায়। প্রকৃতি তাদের বেঁচে থাকার সামগ্রী জোগায়। ফলে ওই নির্দিষ্ট পরিবেশে বিদ্যমান জীবনধারণের উপকরণগুলো তাদের গোষ্ঠী পরিচয়ের অবকাঠামো তৈরি করে। তারা নির্দিষ্ট ধরনের খাবার খায়, পোশাক পরে, নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে। এভাবে, ওই ভৌগোলিক অবস্থানের মানুষগুলোর মধ্যে অবধারিতভাবেই একটা গোষ্ঠী-মনোভাব গড়ে ওঠে, একটা সামাজিক পরিচয় তৈরি হয়। অন্যান্য অনেক গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে থেকে তারা তাদের স্বগোত্রীয় মানুষটিকে আলাদা করে চিনতে পারে। এভাবেই একসময় ‘আমরা’ এবং ‘তারা’ মানসিকতা গড়ে ওঠে, সোশ্যাল বাউন্ডারি বা সামাজিক সীমারেখা তৈরি হয়। সীমারেখার এপাশে বা ভেতরে ‘আমরা’ থাকি এবং ওপাশে বা বাইরে ‘তারা’ থাকে।

জমির যেমন সীমা- নির্ধারণী পিলার বা খুঁটি থাকে, তেমনি সামাজিক পরিচয়েরও সীমাচিহ্ন থাকে। এগুলো হতে পারে দৃশ্যমান কিংবা অধরা চিহ্ন। উদাহরণস্বরূপ- গায়ের রঙ, চোখের রঙ, চুলের রঙ কিংবা শারীরিক গঠন দেখে মানুষের বর্ণ বা গোত্র পরিচয় শনাক্ত করা যায়। আবার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান- এ ধরনের এক বা একাধিক উপাদানও হতে পারে গোষ্ঠী বিশেষের সামাজিক পরিচয়ের সীমানাচিহ্ন। প্রশ্ন উঠতে পারে, সামাজিক পরিচয়ের সীমানা কি অনতিক্রম্য? মানুষ কি তার সামাজিক পরিচয় বদলে ফেলতে পারে না? এই বিশ্বায়নের যুগে মানুষ যখন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দেশান্তরী হচ্ছে, ভিনদেশে ভিন্ন মানুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে, সন্তান জন্ম দিচ্ছে, তখন এ ধরনের প্রশ্ন উঠতেই পারে। হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। তবে বিজ্ঞজনেরা বলেন, এই পরিবর্তন স্থায়ী হতে ন্যূনতম তিনটি প্রজন্ম পার হয়ে যায়। অর্থাৎ যদি আজ কোন বাঙালি তুষার অঞ্চলে গিয়ে কোনো এস্কিমোকে বিয়ে করে সংসার পাতেন, ইগলুতে বসবাস শুরু করেন, সিল মাছের তেল দিয়ে রান্না করে খান, আর শ্বেত ভালুকের চামড়া দিয়ে পোশাক বানিয়ে পরিধান করেন, তার পরও কিন্তু রাতারাতি তার ভেতর থেকে বাঙালি মানসিকতা অদৃশ্য হয়ে যাবে না। তার সন্তানের ভেতরেও বাঙালিয়ানার ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থেকে যাবে। তার নাতিরা হয়তো নিজেদের পুরোপুরি এস্কিমো ভাবতে শিখবে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে কেউ একটি সামাজিক বলয় ছেড়ে আরেকটিতে প্রবেশ করলে তৃতীয় প্রজন্মে গিয়ে তার নতুন পরিচয় স্থায়ী হলেও মূল বলয়টি কিন্তু থেকেই যায়, সেটি বিলুপ্ত হয় না। অর্থাৎ কয়েক হাজার অথবা কয়েক লক্ষ বাঙালি গিয়ে তুষার অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়লেও তৃতীয় প্রজন্মে গিয়ে সবাই এস্কিমো হয়ে যাবে, এস্কিমোরা সবাই বাঙালি হয়ে যাবে না। তেমনি আজ বিপুল পরিমাণে ভিনদেশী তাদের সাংস্কৃতিক তল্পি-তল্পাসহ বাংলাদেশে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসলেও এই ভূখণ্ড থেকে বাঙালিয়ানা উবে যাবে না। কারণ, সীমানা চিহ্নের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী, প্রেরণাদায়ী এবং গভীর যে বিষয়টি একটি গোষ্ঠীর সামাজিক পরিচয় একেবারে ভেতর থেকে ধারণ করে, তা হলো কিছু চিরস্থায়ী, শাশ্বত মূল্যবোধ। এটাকে উপড়ে ফেলা, বদলে ফেলা বা বিলীন করে দেয়া যায় না। হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত গল্প, গাঁথা, কাব্য, কবিতা, সাহিত্য, পুঁথি, শিল্প, স্থাপত্য, গ্রন্থাগার, জাদুঘর, বিদ্যাপীঠ এবং এ ধরনের অসংখ্য বাহন এই মূল্যবোধগুলোকে বহন করে বেড়ায়।

তবে সামাজিক পরিচয়ের পরিবর্তনশীলতা নিয়ে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে- প্রিমরডিয়্যালিস্ট বা আদিমবাদী তত্ত্ব এবং কনস্ট্রাক্টিভিস্ট বা গঠনবাদী তত্ত্ব। আদিমবাদী তাত্ত্বিকরা বলেন, সামাজিক পরিচয় বেছে নেয়ার কোনো ব্যাপার নয়। এটা মানুষ জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে এবং বংশানুক্রমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এটা হস্তান্তর হতে থাকে। ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে মেলামেশার কারণে বাহ্যিক আচার-আচরণে কিছু পরিবর্তন এলেও মৌলিক পরিচয়টা স্থায়ীভাবে থেকে যায় তার অবচেতন মনের গভীরে। অন্য দিকে গঠনবাদী তাত্ত্বিকরা বলেন, সামাজিক পরিচয় পরিবর্তনশীল এবং গঠনযোগ্য। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে একটি গোষ্ঠী তার পরিচয় প্রয়োজনে পরিবর্তন, পরিমার্জন অথবা পুনর্গঠন করে নেয়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, গঠনবাদী তত্ত্বের সাথে রাজনীতির একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সামাজিক পরিচয়ের রাজনৈতিক প্রকাশই হচ্ছে জাতীয় পরিচয়। গঠনবাদী তত্ত্ব এই জাতিগঠন প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে। একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখার ভেতর যখন একাধিক ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বসবাস করে, তখন জাতীয় ঐক্য রক্ষার স্বার্থে জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতারা কিছু শক্তিশালী বয়ান তৈরি করেন। এই বয়ানগুলোতে জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সর্বজনীন মূল্যবোধগুলোর ফোকাস করা হয়। এই বয়ানগুলো বিভিন্নভাবে নতুন প্রজন্মকে শেখানো হয়, যাতে সর্বজনীন মূল্যবোধ ঘিরে ঐক্যভিত্তিক একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, নতুন প্রজন্মের চেতনায় এই মূল্যবোধগুলো সঞ্চালনের সবচে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে জাতীয় পাঠ্যক্রম।

জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আশপাশের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো এ দেশে কখনই জাতিগত বিভেদের নগ্নরূপ প্রকাশ পায়নি, উল্লেখযোগ্য কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি, ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অভিন্ন কিছু সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। জাতিগঠনের জন্যও আমাদের চিরপরিচিত চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে নতুন করে কোনো বয়ান তৈরি করতে হয়নি। স্বাধীনতাযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস এবং চিরন্তন কিছু মূল্যবোধ আমাদের ঐক্যবদ্ধ থেকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। মত, পথ, নীতি কিংবা আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও আমাদের চেতনার গভীরে হাজার হাজার বছর ধরে লালিত এসব শাশ্বত মূল্যবোধ আমাদের জাতীয় ঐক্য সুরক্ষিত রেখেছে।

কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আমাদের ঐক্যের জায়গাটাতে আঘাত আসছে। আমাদের চিরন্তন মূল্যবোধগুলো বিতর্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে একটি ধর্মপ্রাণ জাতির চেতনায় ধর্মহীনতার অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষ যে বিষয়গুলো অপছন্দ করে, পরিত্যাজ্য মনে করে, এমন সব বিষয়ের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির চেষ্টা চলছে। সবচে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, আঘাতটা আসছে আমাদের চিরন্তন মূল্যবোধগুলোর সবচে শক্তিশালী বাহন- শিক্ষাব্যবস্থায়, জাতীয় পাঠ্যক্রমে। টার্গেট করা হচ্ছে সমাজের সবচে স্পর্শকাতর অংশ, আমাদের স্কুলগামী কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের।

বিতর্কিত বিষয়গুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনা করা কিংবা কে ভুল বা কে সঠিক সেটা যাচাই করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। সবচে বড় কথা, পাঠ্যক্রমের কিছু বিষয়কে ঘিরে শিক্ষক-অভিভাবকদের একটি বড় অংশের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। যেহেতু মূলধারার গণমাধ্যমে সাধারণ জনগণের মতপ্রকাশের সুযোগ সীমিত, তাই তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতবিনিময় করছেন, তুমুল প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। পাঠ্যক্রমে নতুন কিছু বিষয়ের সংযোজন এবং পুরনো কিছু বিষয়ের বিয়োজন নিয়ে তাদের আপত্তি আছে। তারা মনে করেন এই ব্যাপারগুলো আমাদের আবহমান নৈতিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। তারা চান না, তাদের সন্তানদের এসব শেখানো হোক। প্রশ্ন হলো, যে বিষয়গুলো নিয়ে সমাজের বিশাল একটা অংশের আপত্তি আছে, সে বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা সংবিধানসম্মত কি না?

আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭ এর উপ-অনুচ্ছেদ খণ্ডত বলা হয়েছে, “[রাষ্ট্র] সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা-প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, [কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন]।’ যে বিষয়গুলো নিয়ে সমাজের বিশাল একটা অংশের তীব্র আপত্তি আছে, সে বিষয়গুলো কি সমাজের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? এই বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার আগে কি জনমত যাচাই করা হয়েছে? জানতে চাওয়া হয়েছে, সমাজ এগুলোর অনুমোদন দেয় কি না? বিদ্যমান মূল্যবোধের পরিপন্থী বিষয়গুলো নবীনদের শেখালে প্রবীণ এবং নবীন প্রজন্মের মধ্যে কি নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে না? পরিবার, সমাজ তথা পুরো রাষ্ট্রজুড়ে কি অনৈক্য তৈরি হবে না? পাঠ্যক্রম কি তবে গঠনবাদীদের খপ্পরে পড়েছে যারা খেয়ালি বয়ান তৈরি করে আমাদের আবহমান জাতীয় পরিচয়টাই মুছে ফেলতে চায়?

যারাই বুঝে বা না বুঝে এটা করছেন, তাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ব্যাপক গবেষণার ভিত্তিতেই সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের অন্তরের গভীরে লালিত গোষ্ঠী বা সামাজিক পরিচয় বদলে ফেলতে কম করে হলেও তিনটি প্রজন্ম চলে যায়। সেটাও হয় শুধু তখনি যখন তাকে এক সামাজিক বলয় থেকে স্থানচ্যুত করে অন্য কোনো সামাজিক বলয়ে বেড়ে উঠতে দেয়া হয়। এটা ১৫ বা ২০ বছরের ব্যাপার নয়। মাঝখান থেকে সমাজে অনৈক্য বাড়বে, বিশৃঙ্খলা বাড়বে, সঙ্ঘাত বাড়বে- সেটা অবশ্যই কাম্য নয়।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি এবং
সঙ্ঘাত বিশ্লেষক
Email: yusuf.researcher.68@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved ©  doiniksatmatha.com