শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ সাধন করে। যা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মধ্যমে চলমান থাকে। হতে পারে এর ব্যাপ্তি, পুরো জীবন ধরে। এই সময়ে মানুষ জ্ঞান, দক্ষতা ও চেষ্টা সাধনায় সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হয়। ক্রমেই তার শারীরিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিকসহ ইতিবাচক সব পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তার অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে সে উন্নত, রুচিশীল ও জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষে পরিণত হয়। মূলত এ জন্যই শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা। এখান থেকেই আমরা শিক্ষা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। এমন মানুষকে আমরা এই মহৎ পেশায় দেখতে চাই, যারা নিজেরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে অন্যের মধ্যেও সেই আলো ছড়িয়ে দিতে পারে।
এই শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকসমাজকে যখন আমরা দায়িত্বশীল আচরণে দেখি, আমরা আশা করি, জাতির মানসিকতায় তাদেরই একটি ছাপ প্রতিফলিত হবে। সঠিক শিক্ষা ও আদর্শে জাতি বেড়ে উঠবে। এ কারণে হয়তো কালে কালে মানুষের কাছে দায়িত্বশীল জ্ঞানী মানুষের সমাদর ছিল সবার উপরে। ধর্মীয় গ্রন্থের বহু জায়গায় এই জ্ঞান ও জ্ঞানী মানুষের কথা বলা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন।’ (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-১১) অন্য দিকে, জ্ঞান সম্পর্কে মহানবী সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জ্ঞানার্জন করা ফরজ’। (ইবনে মাজাহ) সত্যিই জ্ঞান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। যা আল্লাহ সবাইকে দান করেন না। এবার এমন অনেকেও আছে যারা এই নেয়ামত পেয়েও এ দিয়েও নিজেরাও উপকৃত হতে পারে না, অন্যেরও উপকার করতে পারে না। এ জন্য জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করতে জানাই প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়।
আলী রা: বলেন, ‘জ্ঞান ধনসম্পদের চেয়েও উত্তম। কারণ জ্ঞান তোমাকে পাহারা দেয়, কিন্তু অর্থকে উল্টো তোমার পাহারা দিতে হয়। জ্ঞান হলো শাসক, আর অর্থ হলো শাসিত। অর্থ ব্যয় করলে ফুরিয়ে যায় কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে আরো বৃদ্ধি পায়।’ (ইমাম গাজ্জালি, এহইয়াউল উলুম-১/১৭-১৮)
সুফিয়ান সাওরি রহ. বলেন, ‘যে বিষয় আমি জেনেছি, সে অনুযায়ী যদি আমল করি তবেই আমি মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী, আর যদি অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমল না করি তবে দুনিয়ার বুকে আমার চেয়ে অজ্ঞ আর কেউ নেই।’ (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারি-১/২২৮) জ্ঞানকে নিজের কাজে লাগাতে হলে, জ্ঞান থেকে ফায়দা নিতে হলে জ্ঞানের স্বরূপ বুঝতে হবে। ইবনে মাসউদ রা: বলেন, ‘মুনাফিক জ্ঞানের পরিচয় দেয় মুখে আর মুমিন তার আমলের মাধ্যমে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যদি জ্ঞানের অধিকারীরা জ্ঞানকে সংরক্ষণ করতেন এবং যথার্থ স্থানে রাখতেন তবে তারা দুনিয়াবাসীর ওপর জয় লাভ করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, তারা জ্ঞানকে দুনিয়াদারদের কাছে সমর্পণ করেছেন দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ে। ফলে তারা অপদস্থ হয়েছেন।’ (কিতাবুল উম- ১/১৫৬)
একজন জ্ঞানী কখনোই তার দায়িত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে জ্ঞানীর দাবি করতে পারেন না। কারণ জ্ঞানের তাৎপর্য তাকে জ্ঞানী হওয়ার পক্ষ সমর্থন করে না। যতই তিনি দ্বীনদারির দোহাই দেন না কেন, এটি তার নিছক কপটতা ছাড়া কিছু নয়। এখনো আমরা শিক্ষকসমাজকে শ্রদ্ধা করি। জ্ঞানের কদর করি। তাই সবার অবক্ষয় মেনে নিতে পারলেও শিক্ষকসমাজ সে অবস্থানে কখনোই দেখতে চাই বা দেখতে পারি না। যদি কোনো জাতির শিক্ষকসমাজ নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের দিক থেকে ক্রমে দুর্বল হতে থাকে, ধরে নিতে হবে সেই জাতি ক্রমেই দুর্বল জাতি হিসেবে পরিণত হতে যাচ্ছে।
একজন শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষকতা জীবন স্মরণীয় করে রাখাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একজন শিক্ষক আজীবন বেঁচে থাকেন তার শিক্ষার্থীর মধ্যে। অনেক অনেক স্মৃতি আমরা ভুলে গেলেও কিছু স্মৃতি আমরা কখনো ভুলতে পারি না। ভোলাও যায় না। সেই মানুষগুলোর মধ্যে শিক্ষক অন্যতম। বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো না কোনো শিক্ষকের নাম আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে। যার প্রেরণা, যার অনুপ্রেরণা আমরা কখনো ভুলতে পারি না। তাই বৃদ্ধ বয়সেও আমরা অনেককে বলতে শুনি, ইনিই আমার প্রিয় শিক্ষক। মানুষের অন্তরে অন্যের জন্য ভালোবাসা তখনি সৃষ্টি হয়, যখন সে অন্যের থেকে এমন কিছু পেয়ে থাকে; যা তার চাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি। এই যে মানবিক আচরণগুলো কখনো দায়িত্বশীল হওয়ার কারণে প্রকাশিত হয়, আবার কখনো স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের দরুন। কিন্তু এর ব্যত্যয় যখন ঘটে, তখন তার থেকে দায়িত্বহীনতা প্রকাশ পায়, নতুবা অমানবিক কোনো আচরণ। যা মানুষ হিসেবে কোনো বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না।
বিবেকের চেয়ে পীড়াদায়ক যন্ত্রণা বোধ হয় আর কিছু নেই। যে পরিচয় আপনাকে মানুষের সামনে বড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, আপনি তাকে ভুলে গিয়ে, দায়িত্বের প্রতি উদাসীন থেকে, যতই ভালো কাজ আপনি করুন না কেন, তার কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। আমার এক বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ছেড়ে বলল, যে শিক্ষককে পরম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছিলাম, সে এভাবে সর্বনাশ করবে কখনো বুঝতে পারিনি। আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, আমি কি তোমার কথাটা শুনতে পারি? অবশ্যই, কেন নয়। ও বলতে লাগল- আমি একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় থেকে অনেক কষ্টে এমফিল সম্পন্ন করেছি। আমার সুপারভাইজারকে প্রথমে খুব ভালো মনে হলেও একটা পর্যায়ে তার ভণ্ডামিটা আমার চোখে ধরা পড়ল। বারবার মনে হতো, গবেষণা ছেড়ে বেরিয়ে আসি। শিক্ষকের এমন অসহযোগিতা নিয়ে গবেষণাকর্ম শেষ করা যায় না। আবার ভাবতাম, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করাই জীবনের বড় অভিজ্ঞতা। চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত ও কাজটি সম্পন্ন করেছে।
সুপারভাইজার পরিবর্তন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে কেউ তাকে নিতে রাজি হয়নি। তাতে সহকর্মীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হবে। একজন ফেলোর ক্যারিয়ারের চেয়ে তাদের কাছে ব্যক্তি সম্পর্ক অনেক ঊর্ধ্বে! তবে ওই ফেলোকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন, তার কষ্ট বোঝেন, এমন শিক্ষক যে মোটেই নেই, তেমন কিন্তু নয়। একজনের নাম উল্লেখ না করলেই চলে না, যিনি সবসময় শিক্ষকসুলভ দায়িত্বশীলতা ও বন্ধুপ্রতিম মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় পেশ করেছেন। অনাকাক্সিক্ষত সম্পর্ক অবনতির কারণে আমিও তার নামটি গোপন করে গেলাম। তবে তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকবে আজীবন।
এমফিল শেষ করার পর প্রায় তিনটি বছর অতিবাহিত করেছেন এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে, প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই ফেলো পিএইচডির সিনোপসিস এর কাজ শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয় তার কর্মক্ষেত্র হলেও সুপারভাইজার নিজের ব্যস্ততা দেখিয়ে শুধু সময় পার করছেন। প্রায়ই তার বাসায় যেতে হতো। সেখানেও তিনি চরম উদাসীনতার পরিচয় দিতেন। ফেলো নিজেও একজন চাকরিজীবী। প্রায়ই তাকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় যেতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয় শাহবাগে অবস্থিত হওয়ায় সাধারণত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বা নিকটস্থ অন্য কোথাও উঠতেন। এখান থেকে ডিপার্টমেন্টে যাওয়া তার জন্য সহজ। কাজেরও উপযুক্ত পরিবেশ পেতেন। সে সুযোগ তিনি খুব একটা পেতেন না।
ফেলোকে আসতে হতো সুদূর বরিশাল থেকে। তিনি বেলা ১১টা বা ১২টায় ঢাকায় এসে পৌঁছতেন। স্যারকে ফোন করে কন্ট্র্রাক্ট করলে তিনি জানিয়ে দিতেন সন্ধ্যায় বাসায় এসো। ফেলো ঠিকই সন্ধ্যার পরে ৬ বা ৭টায় উপস্থিত হতেন। সুপারভাইজার আসতেন রাত ৯টা বা ১০টায়। এভাবে করে তিনি প্রথমবার পিএইচডির সিনোপসিস জমা দিলেন। ডিপার্টমেন্টে সিনোপসিস জমা দেয়ার পর একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত, শিরোনাম আরো স্পষ্ট করতে হবে। দ্বিতীয়বার ফেলো তার সুপারভাইজারকে নিয়ে বসে সব ঠিকঠাক করে জমা দিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার একাডেমিক কমিটি জানাল, এ বিষয়ে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করার সুযোগ আদৌ নেই। যদি ফেলো এমন একটি বিষয় নির্ধারণ করে থাকেন, যে শিরোনামের ওপর ওই ডিপার্টমেন্টের অনুকূলে সিন্ডিকেট সভায় আপত্তি উঠবে, তাহলে এমন একটি বিষয় কিভাবে সবার চোখ এড়িয়ে প্রথমবার শিরোনাম স্পষ্টকরণের কথা বলা হলো। এ বিষয়গুলো যতই আড়াল করা হোক না কেন? বিবেকের দায় কখনোই এড়ানো যায় না।
সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়রা কি যুক্তি দেখাবেন, আমি জানি না। তবে যে ক্ষতি এই ফেলোর করেছেন তা অপূরণীয়। তাই আমার বন্ধুর তিক্ত শপথ! গবেষণা যদি নাও শেষ করতে পারি, দায়িত্বহীন এসব শিক্ষকের কাছে কখনোই ফিরে যাবো না।
নিবন্ধের শেষ ভাগে নিজের একটি স্মৃতিচারণ দিয়েই আজকের লেখা শেষ করব। আমি নিজেই পিএইচডির জন্য আবেদন করব বলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার অধ্যাপক ড. রাশেদুজ্জামানের কাছে ফোন করি। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। আমি শুধু তার মাধ্যমে অফিস হয়ে এটুকু জানতে চেয়েছিলাম, কখন ও কোন সময় তারা ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয়, হঠাৎ করে স্যার আমাকে একদিন ফোন করে জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সত্যিই, সেদিন আমি তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। অথচ তিনি আমাকে চেনেন না, এমনকি খুব একটা ভালো করে জানেনও না। আমি তার অধীনে কাজ করব সে বিষয়টিও কিন্তু অনিশ্চিত। এক কথায়, আমি তার ফেলো না, তিনি আমার সুপারভাইজারও নন। সেদিন থেকেই এই শিক্ষককে মনের আসনে জায়গা করে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছি। যেদিন তিনি আমায় আরো বললেন, এত কষ্ট করে শুধু ফরম তোলার জন্য সুদূর পিরোজপুর থেকে আপনাকে এখানে আসতে হবে না, আমি বরং ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনি যাবতীয় পেপারস নিয়ে একবারে এলেই চলবে।
যেদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো বলে স্থির করলাম, তার আগের দিন ফোন করে জানালাম, স্যার, কালকে বোধহয় আসছি। স্যার সহাস্যে বললেন, আসুন তাহলে। আমি ওই বিভাগে পৌঁছানোর আগে স্যার সেখানে বসা ছিলেন। তিনি কী যে পরম ভালোবাসায় আমাকে রিসিভ করলেন, সে কথা এখনো ভুলতে পারি না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিশেষ কিছু কারণে শেষ পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি। গবেষণা তার অধীনে হোক আর নাই হোক, যে ভালোবাসা আমি তার থেকে পেয়েছি এ তার মহত্ত্বের লক্ষণ। প্রকৃত অর্থে তাকে আমার একজন শিক্ষক বলেই মনে হয়েছে। হয়তো আমার মানসপট থেকে তার নাম কখনো মুছে যাবে। আমি আল্লাহর কাছে তার উত্তম প্রতিদান কামনা করি। একজন প্রেরণাদায়ী শিক্ষক হিসেবে হাজারও শিক্ষকের মধ্যে তার অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে যাক। শিক্ষক তো এমনই হবেন যিনি মনের দ্যুতি ছড়িয়ে অন্যকে নিজের করে নেবেন। তবেই তিনি শিক্ষক। সার্থক তার জ্ঞানের দীক্ষা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
Leave a Reply