টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপটি নাফনদের পাশে। ওই দ্বীপের বেড়িবাঁধ উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকে সীমানার ওইপার থেকে ভেসে গোলাগুলির শব্দ শুনছেন। আজ শুক্রবার বিকেল পর্যন্তও বিকট শব্দ বন্ধ হয়নি বলে জানালেন।
নাছিরের কথায়, ‘এর আগেও গোলার শব্দ আমরা পেয়েছি। কিন্তু শব্দগুলো এতো বিকট ছিল না। মনে হচ্ছে নাফ নদ কেঁপে উঠছে।’ সীমান্ত এলাকার এই বাসিন্দারা শুনেছেন, আরও কয়েকদিন এমন তীব্র মাত্রার যুদ্ধ চলবে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও রাখাইন অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে বেশ কিছুদিন ধরে জান্তার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে আরাকান আর্মির (এএ)। ছোড়া হচ্ছে একের পর এক মর্টার শেল-গোলা। তীব্র শব্দ ভেসে আসছে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সীমান্ত এলাকায়। এতে এসব এলাকার বাসিন্দাদের দিন কাটছে আতঙ্কের মধ্যদিয়ে।
বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) দিবাগত রাত থেকে গোলাগুলির তীব্রতা টের পেতে শুরু করেন বলে সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। আজ শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপে সীমান্তে ভারী মর্টার শেলের শব্দ শুনতে পেয়েছেন তারা।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা মনে করছেন, মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধটি উভয়পক্ষের জন্য অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ওপারের বেশকিছু সীমান্তচৌকি বিদ্রোহী আরকান আর্মির দখলে। দেশটির সরকারী সীমান্তরক্ষী বাহিনী অনেক সদস্য সংঘর্ষে টিকতে না পেরে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
জানা গেছে, ওপারের যুদ্ধের প্রভাব সীমান্তের এপারে বেশি পড়ছে টেকনাফের উত্তরপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, কাঞ্জরপাড়া, হ্নীলা, মৌলভীপাড়া, ওয়াব্রাং, ফুলের ডেইল, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া এলাকায়। লোকজন থেমে থেমে গুলি ও মর্টার শেল ছোড়ার শব্দ পাচ্ছেন।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, দুই পক্ষের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে রাখাইন রাজ্যের কুমিরহালি, নাইচদং, কোয়াংচিগং, শিলখালী, নাফপুরা ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের উল্টোদিকের হাসসুরাসহ কয়েকটি গ্রামে। ফলে এপারে গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছেন লোকজন।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ‘ঈদের রাত (বৃহস্পতিবার) থেকে মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধে তীব্রতা বেড়েছে। যে কারণে আগের তুলনায় বেশি সংখ্যা বড় আকারের গোলার শব্দ পাচ্ছি। এতে আমাদের ঘরবাড়ি কাঁপছে।’
আজ শুক্রবার জুমার নামজের পরও ওপার থেকে বিকট শব্দ পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় শব্দের তীব্রতায় নারী-শিশুদের ঘুম ভেঙে যায়। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে তারা দিন পার করছেন।
শুক্রবার বিকেল তিনটার দিকে ওপার থেকে গোলার বিকট শব্দ শুনতে পান জাদিমুড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বজ্রপাত মনে করে ভয়ে কেঁপে উঠেছিলেন।
তিনি বলেন, গুলির শব্দে মনে হয় এ পারে এসে গায়ের ওপর পড়ছে। লালদিয়া এলাকায় মর্টারশেল ও গুলির শব্দ বেশি পাওয়া যায়। তবু আপাতত পরিবার নিয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি আরেকটু দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, টানা দুই দিন ধরে থেমে থেমে মর্টারশেল ও গুলির শব্দ আসছে। কাঁপছে সীমান্ত এলাকা। বজ্রপাতের মতো শব্দ হয়। আতঙ্কিত স্থানীয় মানুষের রাত নির্ঘুম কাটছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারাও শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মর্টারশেল ও গুলির শব্দ শুনেছেন। এ বিষয়ে একটি আবাসিক হোটেলের পরিচালক মো. ইসহাক বলেন, ‘রাখাইনে ব্যাপক গোলাগুলি চলছে। বিকট শব্দ এপার থেকে শোনা যাচ্ছে। হোটেল কক্ষের দরজা-জানলাও কাঁপছে। অনেক সময় ভয়ও পাচ্ছি।’ এ অবস্থা দুই দিন ধরে চলছে বলে জানান তিনিও।
গতকাল থেকে সীমান্তে গোলার বিকট শব্দ বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আদনান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা সীমান্ত পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। মানুষ যেন আতঙ্কিত না হয়, সে জন্য খোঁজখবর রাখছি।’ এ ছাড়া নাফ নদ ও সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।
আতঙ্কিত মানুষের খোঁজখবর রাখছেন বলে জানান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম। তিনি বলেন, গতকাল থেকে মিয়ানমারের ভেতর থেকে মর্টারশেল-গুলি বর্ষণের শব্দ পাচ্ছেন সীমান্তের লোকজন। তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। এই সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা গত বছর থেকে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও দেশটির সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আসছেন। যদিও বাসিন্দারা এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে তীব্রতা বাড়লে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
রাখাইনে চলমান যুদ্ধে টিকতে না পেরে গত মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় মিয়ানমার বর্ডার পুলিশের (বিজিপি)১৮০ জন সদস্য। তারা নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবি ব্যাটালিয়নে রয়েছেন। তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এরও আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন ৩৩০ জন। এর মধ্যে ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, ৪ জন বিজিপি পরিবারের সদস্য, ২ জন সেনাসদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য ও ৪ জন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
রাখাইনে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ও বিজিবি। এ বিষয়ে টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, রাখাইনের ভেতর অনেক দূরে গোলাগুলি চলছে। তবে এপারে বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজনের ভয়ের কারণ নেই। এ সমস্যাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রেবেশের বিরুদ্ধে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
Leave a Reply