রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর কাছে এক কনসার্ট হলে বন্দুকধারীর হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ জন নিহত এবং ১০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।
হতাহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশুও রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিবিসির যাচাই করা ভিডিওতে দেখা যায়, ক্রাসনোগর্স্কের উত্তর-পশ্চিম শহরতলিতে ক্যামোফ্লজ গিয়ার বা সৈনিকদের মতো পোশাক পরা অন্তত চার ব্যক্তি এ হামলা চালায়।
ক্রোকাস সিটি হলে বন্দুকধারীরা যখন এর প্রবেশ মুখে এবং পরে থিয়েটারের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটায়, তখন সেখানে একটি রক কনসার্ট আয়োজন করা হচ্ছিল।
ভবনের বেশিভাগ অংশ আগুনে পুড়ে গেছে এবং ছাদের কিছু অংশ ধসে পড়েছে।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে একটি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করে নিন্দা জানিয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি অযাচাইকৃত বিবৃতিতে জানা যাচ্ছে, ইসলামিক স্টেট (আইএস) বলেছে যে তারা এই হামলা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির পার্টনার সার্ভিস সিবিএসকে মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, তাদের কাছে এমন গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে আইএস রাশিয়ায় হামলা চালাতে চেয়েছিল।
এদিকে রুশ ন্যাশনাল গার্ড জানিয়েছে, হামলাকারীদের ধরতে ঘটনাস্থলে বিশেষ ইউনিট কাজ শুরু করছে। এছাড়া শীর্ষস্থানীয় রুশ কর্মকর্তারাও ইতোমধ্যে ক্রাসনোগর্স্কে গেছেন।
দুই সপ্তাহ আগে, মার্কিন দূতাবাস রাশিয়ায় অবস্থিত মার্কিন নাগরিকদের বড় ধরনের জমায়েত এড়িয়ে চলতে একটি সতর্কতা জারি করে বলেছিল, ‘মস্কোতে বড় ধরনের সমাবেশ লক্ষ্য করে উগ্রবাদীরা হামলা চালাতে পারে’ এমন রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখছে নিরাপত্তা বাহিনী।
শুক্রবার সন্ধ্যায় নতুন আরেকটি সতর্কতা দেয়া হয়েছে এবং মার্কিন নাগরিকদের হামলা হওয়া জায়গার আশপাশের এলাকা এড়িয়ে চলতে অনুরোধ করা হয়েছে।
রুশ রক গ্রুপ পিকনিকের কনসার্টের জন্য ক্রোকাস সিটি হল এবং কনসার্ট কমপ্লেক্সে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, ব্যান্ডটি মঞ্চে ওঠার কিছুক্ষণ আগেই হামলা শুরু হয়।
যদিও পিকনিকের ব্যান্ডের সদস্যরা সবাই অক্ষত রয়েছেন।
একজন নিরাপত্তা কর্মী জানান, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হামলাকারীরা কনসার্ট হলের প্রবেশমুখে গুলি ছুড়তে শুরু করে। তিনি ও তার সহকর্মীরা তখন সেখানে কাজ করছিলেন।
তিনি রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল বাজাকে বলেন, তিনি ছাড়া আরো তিনজন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন সেখানে এবং তারা একটি বিজ্ঞাপন বোর্ডের পেছনে লুকিয়ে ছিলেন হামলার সময়।
তিনি বলেন, ‘আক্রমণকারীরা আমাদের থেকে ১০ মিটার দূরে ছিল, পরে তারা নিচতলায় লোকজনের ওপর এলোপাতারি গুলি চালাতে শুরু করে।’
অডিটোরিয়ামের ভেতরে এক নারী বলছিলেন, যখন তারা বুঝতে পারেন গুলি চালানো হচ্ছে তখন তিনি ও অন্য দর্শকরা মঞ্চের দিকে ছুটে যান।
রুশ একটি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, ‘আমি একজনকে দেখেছি যার পাশে অস্ত্র রাখা ছিল, এবং সেখান থেকে গুলি চালাচ্ছিল সে। আমি তখন ক্রল করে একটা লাউডস্পিকারের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করছিলাম।’
আগুন এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওপরে উঠে গিয়ে এক পর্যায়ে কনসার্ট হলের সামনে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভবনটির ওপরের দো’তলার কাঁচ উড়ে যায়।
হামলাকারীরা আগুন ধরানোর জন্য কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে মনে হচ্ছে।
ভিটালি নামের এক ব্যক্তি কনসার্ট থিয়েটারের একটি বারান্দায় থাকা অবস্থায় হামলাকারীদের গুলি চালাতে দেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘তারা পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মেরেছে, এরপর সবকিছু পুড়তে শুরু করে। তারপর আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।’
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, হামলার সময় শিশু ও কিশোররা ওই কমপ্লেক্সে ছিল, তারা সেখানে একটি বলরুম ডান্সের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছিল।
যদিও কনসার্ট হলে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কিছু মানুষ মঞ্চ থেকে পার্কিং এরিয়ার দিকে সরে যেতে সক্ষম হন। অন্যরা ছাদের দিকে যান।
রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বলছে, আরো অন্তত ১০০ জন বেজমেন্টের মধ্য দিয়ে সরে যেতে পেরেছেন।
সাথে সাথে ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়। হামলার কিছুক্ষণ পর থেকেই ওই কমপ্লেক্সের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায়।
মস্কোর মেয়র সের্গেই সনিয়ানিন রাজধানীতে সব পাবলিক ইভেন্ট বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘যারা স্বজন হারিয়েছে তাদের জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।’
ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পিটার্সবার্গসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলে সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাকারোভা এ ঘটনাকে জঘন্য অপরাধ আখ্যায়িত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান।
ওদিকে ইউক্রেন সরকার দ্রুতই এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, এর সাথে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
তবে কোনো নাম উল্লেখ না করে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা মুখপাত্র আন্দ্রি ইয়সভ বলেন, হামলার ঘটনা পুতিনের স্পেশাল সার্ভিসের উষ্কানিমূলক কাজ।
তবে তিনি কোনো প্রমাণ দেননি।
শুক্রবার রাতের এ হামলা রাশিয়ায় বহু বছরের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। এর আগে ২০০২ সালে ৪০ চেচেন উগ্রবাদী একটি অনুষ্ঠানে প্রায় ৯০০ জনকে বন্দী জিম্মি করেছিল।
পরে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছিল। ওই ঘটনায় ১৩০ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছিল।
এদিকে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, গুলির ছবিগুলো ‘ভয়াবহ এবং দেখাই কঠিন’।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply