ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক যুদ্ধ : সামনে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ফাঁদ

Reporter Name
    সময় : সোমবার, এপ্রিল ২১, ২০২৫, ৭:০৪ অপরাহ্ণ
  • ২২৪ Time View
এফ শাহজাহান : উপমহাদেশের অগ্নিগর্ভ দুই নিকটতম প্রতিবেশি ভারত আর বাংলাদেশ ক্রমেই একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থানের নিকটবর্তী হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে একদিকে চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ আরেক দিকে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক যুদ্ধ। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলানোর আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠছে।
ভারত-বাংলোদেশের চলমান বানিজ্যযুদ্ধ,আর কূটনৈতিক যুদ্ধের মধ্যেই আগুনে তেল ঢালার মতো করে হাজির হয়েছে দিনাজুরের বিরল উপজেলার হিন্দু নেতা ভবেশ রায়ের রহস্যজনক মুত্যুর ঘটনা।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়ানোর প্রতিবাদ এবং ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তার দাবি তোলায় ভারত এখন গায়ে পড়ে বাংলাদেশকে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। এরফলেই দুই দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধ ক্রমেই জটিল হচ্ছে।
বিদ্যমান বাণিজ্যযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই গত ৩ দিনের ব্যবধানে দুই দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধও বেশ তেতে উঠেছে।
পলাতক ফ্যা*সি*স্ট হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পর থেকেই ভারত যে কোন ছলছুতায় বাংলাদেশকে ঘায়েল করার ফন্দিফিকির করে যাচ্ছে। এবার তাতে নতুন করে বাতাস লাগাচ্ছে ভবেশ রায়ের রহস্যজনক মুত্যু।
কিন্তু এই ভবেশ রায়ের রহস্যজনক মুত্যুর পেছনে এক কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেছে। সেই কাকতালীয় ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গেলেই ভবেশ রায়ের মৃত্যুর ঘটনা তালগোল পাকিয়ে আরো জটিল আকার ধারণ করছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়ানোর ভারতীয় অপচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে ছিলো বাংলাদেশ ।
এরপরেই শুরু হয়ে যায় ভারত-বাংলাদেশের তুমুল কূটনৈতিক যুদ্ধ।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বলেছিলেন , ‘মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যে কোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি। সেইসঙ্গে ’বাংলাদেশ সরকার ভারতের মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তাঁদের জানমালের নিরাপত্তাহানির ঘটনার নিন্দা জানায়।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।’
বাংলাদেশে সরকারের প্রেস সচিবের এই বক্তব্যে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে ভারত। বাংলাদেশ এমন সুরে ভারতকে জবাব দিবে তা কল্পনাও করেনি তারা। তাই বাংলাদেশের এই বক্তব্যে প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে পাল্টা জবাবের রাস্তা খুঁজতে থাকে ভারত।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের সুরক্ষার এই দাবিতে নয়াদিল্লি বিশেষভাবে সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ হয়েছে। কারণ, এর আগে বাংলাদেশ সরকার কখনই এভাবে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার দাবি তোলার সাহস পায়নি। তাই ইউনূসের প্রেস সচিবের বক্তব্য ভারত মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।
ভারত এরপরই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎপেতে ছিলো কীভাবে বাংলাদেশের এই বক্তব্যের একটা কড়া জবাব দেওয়া যায়। আর সেই সুযোগ খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে যায় ভারত। বাংলাদেশের বক্তব্যের কয়েকঘন্টা পরই ভবেশ রায় হত্যা কাহিনীর মোক্ষম সুযোগটি লুফে নেয় ভারত।
১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বিবৃতি প্রকাশের কয়েক ঘন্টা পরেই দৃশ্যপটে হাজির হয় বাংলাদেশের দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভবেশ চন্দ্র রায়ের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা। এটাকে একটা কাকতালীয় ঘটনা মনে হলেও আসলে তা নাও হতে পারে। কারণ, ভবেশ রায়ের মৃত্যুকে যেভাবে দাবার ঘুঁটি বানাচ্ছে ভারত,তাতে এর পেছনে অন্যকিছু থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
ভবেশ চন্দ্র রায়ের রহস্যজনক মৃত্যুকে দাবার ঘুঁটি বানিয়ে রাত পোহলেই ১৭ এপ্রিল শুক্রবার নতুন চাল মারেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি বলেন, ভারতের মুসলিমদের সম্পর্কে অযৌক্তিক ও গোপণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত মন্তব্য না করে বাংলাদেশের বরং নিজেদের সংখ্যালঘুদের রক্ষায় আরও মনযোগ দেওয়া উচিত।
ঐদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল আরও বলেন, “অযৌক্তিক মন্তব্য এবং ভালো সাজার চেষ্টা না করে, বাংলাদেশ তার নিজ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার দিকে মনোনিবেশ করলে বরং আরও ভালো করবে।”
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য দায়ীরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র রণবীর জয়সওয়াল।
এখানে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, ভারতের মুসলমানদের সুরক্ষার দাবিতে বাংলাদেশের বিবৃতি দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাংলাদেশে হিন্দু নেতা ভবেশ রায় খুন হলেন। আর সেই ভবেশ রায় ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশকে কড়া জবাব দেওয়ার একটা মওকা পেয়ে গেলো ভারত।
ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে যে কেউ সন্দেহ করবেন যে, বাংলাদেশের বিবৃতির বিরুদ্ধে একটা পাল্টা জবাব খাড়া করার জন্যই কী বলির পাঁঠা হয়ে গেলেন দিনাজপুরের ভবেশ রায় ?
বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ অমুসলিম রয়েছে। আর ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা ২৫ কোটির মতো বলে জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। আর পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি। ফলে ভারত-বাংলাদেশের এই সংখ্যালঘু বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দিন দিন স্পর্ষকাতর ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে।
ভারত ভাগের পর নেহরু লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল পরস্পরের দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার উপর নজর রাখার জন্য। নয়াদিল্লি সেই অনুযায়ী পাকিস্তাননের কাছে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার হিন্দু দের নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। পাকিস্তানও ভারতের বিভিন্ন দাঙ্গার সময় একই অভিযোগ করেছে। এতে অবশ্য দুই দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থার তেমন কোনও হেরফের হয়নি।
বাংলাদেশ এর আগে কখনই এই স্পর্শকাতর বিষয়ে ভারতের দিকে আঙুল তোলেনি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সম্ভবত এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারিভাবে সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিয়ে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গকে বিদ্ধ করল। ভারতও জবাব দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের উচিত আগে নিজের ঘরের দিকে নজর দেওয়া।
এর মধ্যে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের দিনাজপুরে বিরাল উপজেলার একজন হিন্দু নিহত হয়েছে। তাঁর নাম ভবেশ চন্দ্র রায় (৫৮)। তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অর্ধমৃত অবস্থায় তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়।
পরিবার-পরিজনরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ভবেশ চন্দ্র রায়কে কারা হত্যা করেছে? কেন করেছে? তার কোনও তদন্ত রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি।
দু’টি বাইকে করে এসে অপহরণকারীরা তাঁকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভবেশ চন্দ্র রায় আওয়ামি লিগ বা কোনও হিন্দু সংগঠনের নেতৃত্ব পদে ছিলেন না। তবে তিনি তাঁর গ্রামের পুজা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। মিডিয়া তাঁকে ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে অভিহিত করেছে।
ভারত সরকারও ভবেশ চন্দ্র রায়ের হত্যাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। বিদেশ দফতর বলেছে, ভবশে চন্দ্র রায়ের হত্যাকান্ড হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর সিস্টেমেটিক নির্যাতনের নজিরমাত্র। এর অপরাধীরা কখনই শাস্তি পায় না। বিদেশ দফতর আরও বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা বলব, আপনারা সংখ্যালঘু ও হিন্দু দের রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করবেন। এর জন্য কোনও অজুহাত খুঁজবেন না।
ভারতের কংগ্রেস দলও এই ঘটনার নিন্দা করেছে। জয়রাম রমেশ এবং খাড়গে কড়া ভাষায় এই ঘটনার প্রতিবাদ করে মোদি সরকারকে হিন্দুদের রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নিতে বলেছে।
বাংলাদেশে ও ভারতে যে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে, তা এখন আর গোপন নয়। কিন্তু নয়াদিল্লি বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতার সংক্রান্ত সংস্থা বা মার্কিন সরকারের কোনও বিভাগ যদি ভারতের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার উপর কোনও বিবরণ বা বক্তব্য দিয়েছে, ভারত কঠোর ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বহালতবিয়তে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওআইসি-র রিপোর্টকেও ভারত প্রত্যাখ্যান করে নিজ চরকায় তেল দিতে বলেছে।
ভারতে বিলকিস বানু বা গ্রাহাম স্টেইনস-এর ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের মুক্তি দিয়ে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সেখানকার গো-রক্ষকরা অবাধে সন্দেহের বশে বহু মুসলিমকে হত্যা করছে। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে শত শত বছরের মসজিদ, মাদ্রাসা সরকারই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়। এসব ঘটনাকে ভারত বরাবরই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করে।
সাম্প্রতিক সময়ের ভারত-বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক যুদ্ধের ডামাডোলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বলির পাঁঠা বানানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে বিষয়ে বাংলাদেশ এখনই সতর্ক না হলে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলে চরম প্রতিশোধের জন্য মরিয়া উঠতে পারে ভারত।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved ©  doiniksatmatha.com