ভারতের আদিনা মসজিদে হিন্দু সাধুর পূজা!

সাতমাথা ডেস্ক:
    সময় : বুধবার, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ১২:২৪ অপরাহ্ণ
  • ২০১ Time View

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার প্রাচীন আদিনা মসজিদে গত রোববার হঠাৎ করেই পূজার আয়োজন করেন হিন্দু সাধু হিরণ্ময় গোস্বামী। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কয়েক বছর ধরেই হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ দাবি করতে শুরু করেছে, আদিনা মসজিদ আসলে আদিনাথ মন্দির ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল। যদিও কোনো ঐতিহাসিকের লেখাতেই এই তত্ত্ব পাওয়া যায় না।

প্রত্মতাত্ত্বিক নির্দশন হিসেবে সংরক্ষিত এই মসজিদে নামাজ পড়া হয় না।

হিন্দু সাধুর পূজা করার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত তিন দিন ধরে আলোচনায় উঠে এসেছে আদিনা মসজিদের নাম।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, বাঙালী সাধু হিরণ্ময় গোস্বামী আদিনা মসজিদ চত্বরে হিন্দু রীতি মেনে পূজা করছেন এবং এক ব্যক্তি তাকে বাধা দিচ্ছেন, দুই পক্ষের তুমুল বাকবিতণ্ডা হচ্ছে।

বাধা দেয়া ওই ব্যক্তিকে পরে চিহ্নিত করা হয়েছে পুলিশের এক সদস্য হিসেবে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একদিকে গোস্বামী বলছেন যে ‘কোথায় লেখা আছে যে এখানে প্রণাম করা যাবে না’, অন্যদিকে ওই সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্য কর্মী তাকে বলছেন, এখানে পূজা দেয়া যায় না।

গোস্বামী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথেষ্ট পরিচিত।

‘সনাতনী সম্পদ’
বেনারস নিবাসী বাঙালি এই সাধু বলেন, ‘ভাগবত পাঠ করতে মালদায় এসেছিলাম। যে স্থান আমাদের কোনো পীঠস্থান, সেটা আমাদের বড় আদরের, আমাদের বন্দনীয়। গৌরেশ্বরের একটা বড় পীঠস্থান হচ্ছেন আদিনাথ। সেটা আমাদের আরাধ্য পীঠ। সেই সূত্রেই আমাদের আগমন।’

তবে এর সাথে একমত নন ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ।

আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া বা ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ বলছে, আদিনা মসজিদ তাদের সংরক্ষিত সৌধ। দফতরের এক পুরাতাত্ত্বিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘আমাদের সৌধগুলোর দু’টি ভাগ আছে। একটা লিভিং আরেকটা নন-লিভিং। আদিনা মসজিদ একটি নন-লিভিং সৌধ এবং আইন অনুযায়ী এখানে কোনো ধরনের পুজো-অর্চনা, নামাজ পড়া যায় না। কোনো ধর্মীয় রীতি নীতিই এখানে পালন করা যায় না।’

ওই কর্মকর্তার কথায়, একটি সৌধ যখন এএসআই সংরক্ষিত সৌধের তালিকায় যুক্ত হয়, সেই সময়ে সেখানে যদি কোনো ধর্মীয় আচার পালন চলতে থাকে, সেটা চলতে দেয়ার কথা আইনেই আছে। এগুলোকে বলে ‘লিভিং’।

আর যে সৌধ সংরক্ষণের তালিকায় যুক্ত করার সময়ে সেখানে কোনো ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করা হতো না, সেগুলোকে বলা হয় ‘নন-লিভিং’। আদিনা মসজিদ দ্বিতীয় এই তালিকায় আছে, কারণ যখন এএসআই এটিকে সংরক্ষিত সৌধের তালিকায় যুক্ত করেছিল, সেখানে নামাজ পড়া বা ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠান হতো না।

সেই হিসেবে নতুন করে নামাজ পড়া বা সেখানে পূজা দেয়া আইন বিরুদ্ধ।

পুরাতত্ত্ব বিভাগের এই আইন ভেঙে কেন তাহলে পুজো করলেন গোস্বামী?

এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সনাতনী সম্পদ। তবে সনাতনী যে চিহ্নাদি এখানে রয়েছে, সেগুলো মিটিয়ে দেয়ার একটা বিপুল চেষ্টা চলছে। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, যাতে আমরা এই সনাতনী সম্পদকে পুনরুদ্ধার করতে পারি।’

হিরণ্ময় গোস্বামী যেটাকে ‘সনাতনী সম্পদ’ বলছেন, অর্থাৎ আদিনা মসজিদ আসলে আদিনাথ মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন, সে সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।

‘কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি পাইনি’
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে একটা বই লেখেন অরুণ শৌরিসহ আরো কয়েকজন। বইটার নাম ছিল হিন্দু টেম্পলস হোয়াট হ্যাপেন্ড টু দেম, অর্থাৎ হিন্দু মন্দিরগুলোর কী হয়েছিল, তা নিয়ে একটা প্রাথমিক সমীক্ষা। সারাদেশে কোন কোন মসজিদ পুরনো মন্দির ভেঙ্গে তৈরি করা হয়েছিল, তার একটা প্রাথমিক তালিকা দেয়া হয় বইটিতে। ওই বইতেই প্রথম লেখা হয় যে আদিনাথ মন্দির ভেঙ্গে আদিনা মসজিদ বানানো হয়েছিল। কিন্তু আমি বহু খুঁজেও এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি পাইনি।’

আদিনা মসজিদের নির্মাণ শেষ হয় ১৩৭৪ সালে। ওই সময়ে সেটাই ছিল উপমহাদেশের বৃহত্তম মসজিদ।

ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম মহাপরিচালক আলেকজান্ডার কানিংহাম আদিনা মসজিদ নিয়ে লিখেছেন, ‘এটিকে বাঙালিরা বিশ্বের অত্যাশ্চর্যের অন্যতম বলে মনে করে।’

তার ‘রিপোর্ট অফ আ ট্যুর ইন বিহার অ্যান্ড বেঙ্গল ইন ১৮৭৯-৮০’ বইতে লিখেছেন পাণ্ডুয়ার (বর্তমানের মালদা জেলার অংশ) অসংখ্য নির্মাণ এবং ভাস্কর্যগুলোর মাধ্যমে প্রায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে সেখানে অতীতে হিন্দুদের অবস্থান ছিল। কিছু এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিছু আদিনা মসজিদ, একলাখি মসজিদ আর নূর কুতব আলমের সমাধিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘কানিংহাম কোথাও এটা লেখেননি যে পান্ডুয়া ধ্বংস করা হয়েছিল। যদিও তিনি এটা লিখেছেন যে গৌড়, পান্ডুয়া আর আশপাশের এলাকার প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্যগুলোতে তারও পূর্বেকার নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার প্রচলন ছিলই।’

তার কথায়, এতে এটা প্রমাণ হয় না যে মন্দির ভেঙ্গে সেখানে মসজিদ গড়া হয়েছিল।

মন্দির-মসজিদ বিতর্ক
উত্তর প্রদেশে অযোধ্যা, কাশি আর মথুরায় মন্দির-মসজিদ বিতর্ক বহু বছর ধরেই চলেছে। অযোধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রকাণ্ড রাম মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাশির জ্ঞানবাপী মসজিদ আর মথুরার শাহী ঈদ্গাহ নিয়েও বিতর্ক আর মামলা মোকদ্দমা চলছে।

দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের দুটি ইসলামী স্থাপত্য নিয়েও একইভাবে ‘হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ বানানো হয়েছিল’ বলে দাবি তোলা হচ্ছে।

হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে জাফর খাঁ গাজির দরগাহ্ এবং মালদার আদিনা মসজিদ নিয়ে এই দাবি করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।

ত্রিবেণীতে গত দুবছর ধরে শুরু করা হয়েছে একটি কুম্ভ মেলা। বলা হচ্ছে যে সেটি নাকি ৭০০ বছর আগে চালু ছিল, তারপরে মুসলমান শাসনামলে তা বন্ধ হয়ে যায়।

যেখানে কুম্ভ মেলা শুরু হয়েছে, তার পাশেই জাফর খাঁ গাজির দরগাহ্।

এই কুম্ভ মেলার ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের পিএইচডি থিসিসে মাত্র কয়েকটি শব্দ পরিবর্তন করে দিয়ে এক জাল নথি সামনে আনা হয়েছিল।

যদিও হিন্দুত্ববাদী যেসব সংগঠন ওই কুম্ভ মেলা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারা দাবি করেন যে তাদের কাছে অন্য নানা প্রমাণ আছে যে ৭০০ বছর আগে কুম্ভ মেলা হতো সেখানে।

আবার এখন আদিনা মসজিদ নিয়ে বিতর্ক নতুন করে মাথা চাড়া দিল।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের কথায়, ‘এই দুটি ইসলামী স্থাপত্য নিয়ে মোটামুটি একই সময়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। দুটিকে আলাদা করে দেখলে চলবে না।’

‘ভোটের আগে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা’
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের নেতা মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, আদিনা মসজিদে নামাজ পড়া না হলেও সেটি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন।

তিনি বলেন, ‘নামাজ পড়া না হলেও ঐতিহাসিকভাবে তো এটা সত্য যে সেটি একটি মসজিদ। সেখানে কেন পূজা করতে হবে, তাও বেনারস থেকে এসে? বাংলার মানুষ কি পুজো করে না? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা এটা বোঝাই যাচ্ছে।’

তার কথায়, ‘যেকোনো জায়গায় মনে হলো আর পুজো করা হলো, এটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা। হিন্দুত্ববাদীরা সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছে লোকসভা নির্বাচনের আগে। এটা অন্যায়। প্রশাসনের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।’
সূত্র : বিবিসি

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved ©  doiniksatmatha.com