দীর্ঘ দেড় দশক ধরে কঠিন সময় কাটাচ্ছে জামায়াত। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসি হয়েছে প্রায় সব শীর্ষ নেতার। বাতিল হয়ে গেছে নিবন্ধন। স্বাভাবিক রাজনীতিও কার্যত নিষিদ্ধ। কার্যালয়গুলো তালাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালন করছেন ডা. শফিকুর রহমান। তিনিও দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গত মার্চে মুক্তি পান। এরপরই অংশ নিয়েছেন একাধিক ইফতার পার্টিতে। ছুটে গেছেন দেশের নানা প্রান্তে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় জামায়াতের রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে।
ডা. শফিকুর রহমান অবশ্য তা মানতে নারাজ। তার বিশ্বাস জামায়াত ঘুরে দাঁড়াবে। গেল নির্বাচন বর্জনে বিরোধী দলগুলোর সিদ্ধান্ত সঠিক বলেও মনে করেন তিনি। জোটবদ্ধ আন্দোলনের ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা কথা বলেছেন নানা ইস্যুতে।
নির্বাচন বর্জন ভুল ছিল না: বিরোধীদলগুলো বিগত নির্বাচন বর্জন কি ভুল ছিল? অনেকেই এখন এ প্রশ্ন তুলছেন। এ ব্যাপারে জামায়াতের আমীর বলেন, আমাদের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আমরা নির্বাচন বর্জনকারী দলসমূহ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূলত দেশে ৭ই জানুয়ারি কোনো নির্বাচন হয়নি। দেশের জনগণ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেছে মাত্র। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছর ধরে দেশে কোনো নির্বাচন নেই। নির্বাচনের নামে প্রহসন করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে মাত্র। এ পরিস্থিতি অবসানের লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জামায়াত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে: একসময়কার জোটসঙ্গী বিএনপি এবং জামায়াত। তবে সে সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। সর্বশেষ আন্দোলনে বিএনপি’র সঙ্গে মিলিয়ে কর্মসূচি দিলেও যুগপৎ আন্দোলনে ছিল না জামায়াত। দৃশ্যত বিএনপিই জামায়াতের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখছে। জামায়াত নিয়ে দেশি-বিদেশি কিছু শক্তি ও দলের আপত্তির কারণেই এটা ঘটেছে। যদিও জামায়াতের আমীর মনে করেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের জন্য বিশেষ করে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জামায়াত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে। আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা প্রসঙ্গে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যত দিন পর্যন্ত দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হবে, তত দিন আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। জামায়াত তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
জামায়াতের সমর্থন বেড়েছে: বিপর্যস্ত এই পরিস্থিতি থেকে কি জামায়াত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জামায়াত একটি আদর্শবাদী দল। জেল, জুলুম, নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও হত্যা করে একটি আদর্শবাদী আন্দোলনকে দমানো যায় না। বিগত ১৫ বছর ধরে বর্তমান সরকার জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দি করে জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, নায়েবে আমীর, সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্যসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দিয়েছে। জামায়াত সকল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তার আদর্শিক আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। জনগণ জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে। জামায়াতের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। জামায়াত ক্রমেই একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। কাজেই চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা নিয়ে জামায়াত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ। জামায়াতের ভবিষ্যত রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, জামায়াত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন। আমাদের কার্যক্রম শুধুমাত্র রাজনীতি ও নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জামায়াতের অন্যতম প্রধান কাজ হলো দেশের মানুষকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেয়া এবং কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে তৈরি করা। এজন্য জামায়াত মানুষকে সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষা দেয় এবং তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক সংশোধনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া জামায়াতের অন্যতম কর্মসূচি হলো দেশের জনগণের সেবা করা তথা দুর্গত ও দুস্থ মানবতার কল্যাণ করা। জামায়াত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার জন্য দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেয়, অসুস্থ লোকদের চিকিৎসাসেবা দেয় এবং ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সহায়তা প্রদান করে। জামায়াত দেশের জনগণের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছে। উপরোল্লেখিত কাজগুলোই জামায়াতের স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক কাজ। এ কাজে জামায়াত নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক কৌশল অত্যন্ত পরিষ্কার। আমরা নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জামায়াত জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী। দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তির সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক দল করার অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে এই অধিকার হরণ করার কোনো সুযোগ নেই। জামায়াত নিবন্ধন লাভ করার পর সরকারের মদদে জামায়াতের নিবন্ধনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সর্বশেষ উচ্চ আদালত আমাদের আপিল ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ করে দেয়। এ পরিস্থিতিতে আমাদের আইনজীবীগণ আইনি দিক বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
মানবজমিন এর সৌজন্যে
Leave a Reply