কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা ছিল না, এখনো নেই। তবে ‘জয়ের সম্ভাবনা’ আছে- এমন উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচ শতাধিক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছিল জামায়াত। সংশ্লিষ্ট উপজেলা, জেলা কমিটি এবং আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যকার সিরিজ আলোচনা এবং তাদের সুপারিশের প্রেক্ষিতে ওইসব প্রার্থী ঠিক হয়েছিল। উপজেলা পর্যায়ে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি তথা ‘আঞ্চলিক দায়িত্বশীল’রা সফর করে তৃণমূলের মতামত এবং রিপোর্ট নিয়েছিলেন। সেই রিপোর্ট ধরেই কোন প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু সেই ধারণা বা অনুমান করা হয়েছিল। সেখানে উপজেলাওয়ারী দলের সাংগঠনিক অবস্থা, সম্ভাব্য প্রার্থীর সামাজিক অবস্থান তথা ভাবমূর্তি, মানুষের মাঝে শাসক দলের নেতাদের (স্থানীয়) অবস্থান, ক্ষমতার বেনিফিশিয়ারিদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জেরে বিরোধী মতের প্রার্থীর ‘জয়ের সম্ভাবনা’র বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সেই অনুযায়ী মনোনীত প্রার্থীরা ইফতার মাহফিল, ঈদ পুনর্মিলনীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে উঠান বৈঠক করে গত শুক্রবার পর্যন্ত (ঈদের পরদিন) ভোটারদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু না, উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে অতিসম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সর্বশেষ কেন্দ্রীয় পর্যালোচনা সভায় কোনো ফর্মেটেই দলীয় পদ-পদবিধারী নেতাদের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সোমবার প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ছিলো। এই দিনে নতুন করে জামায়াতের কোন নেতা প্রার্থী হননি।
আগে যারা মনোনয়ন (অনলাইনে) দাখিল করে ফেলেছেন তারা যথানিয়মে যথা সময়ে তা প্রত্যাহার করে নিবেন বলে জানা গেছে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পেয়ে তারা তাৎক্ষণিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সুত্র মতে, পরবর্তীতে ভোট হবে এমন প্রার্থীদেরও আপাতত ভোট চাওয়া বন্ধ করে সংগঠনের রুটিন কার্যক্রমে মনোনিবেশ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিমও কোনো ফর্মেটে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি খোলাসা করে বলেন, আমরা এই নির্বাচনে যাচ্ছি না, এটাই আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। শুধু প্রথম ধাপ নয়, উপজেলা নির্বাচনে কোনো ধাপেই, কোনো ফর্মেটে আমাদের নেতা বা দায়িত্বশীল কেউ অংশগ্রহণ করবে না। এদিকে দলটির দায়িত্বশীল অন্য এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, গত ১৫ বছর ধরে শাসক দলের চরম রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার বাংলাদেশ জায়ায়াতে ইসলামী। সেই আক্রোশ চরিতার্থ করতে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে বিচারের নামে বছরের পর বছর কারাগারে রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে। নতুন নেতৃত্বকেও নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। টার্গেট একটাই রাজনৈতিকভাবে জামায়াতকে ধ্বংস করা। কিন্তু স্রষ্টার কৃপায় তারা তা করতে পারেনি। এখন নানাভাবে তারা জামায়াতকে ট্রাপে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টাও করেছে। কিন্তু তারা তাতেও সফল হয়নি। রাজনৈতিক কারণে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড-গ্রাম পর্যায়ে আমাদের নেতাদের হয়রানি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্ধেকের কম উপজেলায় প্রার্থীতার চিন্তা ছিলো। তাও দলীয়ভাবে নয়, স্থানীয়দের সুপারিশে। সেখানেও তারা ‘ষড়যন্ত্র’ শুরু করেছে। আমরা মনে করি রাজনৈতিকভাবে শাসক দল আমাদের প্রার্থীর সামনে টিকতে পারবে না। এমনকি বিএনপি’র কোনো প্রার্থীকে ভোটে হারানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু সেটা তো তারা করতে দিবে না। এরইমধ্যে বিভিন্ন রিপোর্টে ‘এমপিতন্ত্র’ কায়েমের খবর এসেছে। সব মিলিয়ে আমাদের শীর্ষ নেতৃত্ব এই সরকার তথা নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের যৌথ প্রযোজনায় অনুষ্ঠেয় প্রহসনের ভোটাভুটিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আছে কিনা? জানতে চাইলে দলটির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এ নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি নেই। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেই আমরা সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। তিনি বলেন, কেবল জামায়াত নয়, দেশবাসী নিশ্চয়ই আসন্ন নির্বাচনটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখবে। সবাই হয়তো দেখবে স্থানীয় পর্যায়ের ভোটে শাসক দলের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা? দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কোনো নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- এমন প্রশ্নে মিস্টার আকন্দ বলেন, জামায়াত একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল। দল যে সিদ্ধান্ত নিবে নেতাকর্মীরা সেই অনুযায়ী কাজ করবেন। জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরও অভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে আমাদের কোনো প্রার্থী থাকছেন না, আপাতত দলীয় সিদ্ধান্ত এটাই। ব্যক্তিগতভাবে কোনো নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা? এমন প্রশ্নে ড. তাহের বলেন, জামায়াতে এই ট্র্যাডিশন নেই।
স্মরণ করা যায়, গত ৯ই মার্চ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন উপনির্বাচন হয়। তাতে অনেক জায়গায় জামায়াতের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। এর মধ্যে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী ফারুক হোসেন জয়ী হন। গত ২১শে মার্চ উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সারা দেশে ৪ ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ৮ই মে। দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ হবে ২৩শে মে, তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ ২৯শে মে এবং চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ৫ই জুন। ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদ চালু হয়। বর্তমানে দেশে ৪৯২টি উপজেলা রয়েছে।
এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকছে না। সুযোগ নেই দলীয় প্রার্থিতারও। এই সুযোগে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটসঙ্গী অনেক নেতা প্রার্থী হচ্ছেন। তবে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়েছে। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামায়াতের শতাধিক প্রার্থী চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলাসহ) নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ২৪ উপজেলায় চেয়ারম্যানসহ ৩৯ জন ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলাসহ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত। দলের নিবন্ধন না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল জামায়াত নেতাদের। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তে সেবার কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি।
Leave a Reply