ইসরায়েলের ওপর ইরানের নজিরবিহীন হামলা তার শত্রু তেহরান সম্পর্কে ইহুদিবাদী দেশটির বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এ হামলা তেল আবিবের দীর্ঘকালের হিসাবনিকাশকে ভুল প্রমাণ করেছে যে, বৃহত্তর ইসরায়েলি আগ্রাসনের মাধ্যমে ইরানকে সর্বোত্তমভাবে নিবৃত্ত করা সম্ভব। সোমবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে এসব কথা বলা হয়।
বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যুক্তি দিয়ে আসছেন, ইরানকে যত বেশি আঘাত করা হবে ততই তার যুদ্ধের ক্ষমতা খর্ব হবে। তবে গত শনিবার একযোগে ইরানের ৩০০টিরও বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত ছিল ইসরায়েলের ওপর ইরানের প্রথম সরাসরি আক্রমণ। এ হামলা ইসরায়েলি যুক্তিকে উল্টে দিয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় তেহরান এ আক্রমণ চালায়।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, এতে বোঝা যাচ্ছে ইরানের নেতারা আর তাদের বিভিন্ন প্রক্সি বা ছায়াশক্তি, যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুথিদের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে সন্তুষ্ট থাকছেন না। বরং ইরান এখন সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত।
ইসরায়েলের বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রাক্তন গবেষণা প্রধান সিমা শাইন বলেছেন, ‘আমি মনে করি আমরা ভুল হিসাবনিকাশ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের এতদিনের অভিজ্ঞতা হলো যে ইরানের প্রতিশোধ নেওয়ার শক্তি নেই। ইসরায়েলি নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ইরান যুদ্ধে জড়িত হতে চায় না। কিন্তু ইরান এখন একটি সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
ইরানের হামলায় অবশ্য শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের তেমন ক্ষতি হয়নি। কারণ, হামলার বিষয়টি আগেভাগেই জেনে যাওয়ায় ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রস্তুত করতে বেশ কয়েক দিন সময় পেয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ইরান দেখিয়েছে তার যথেষ্ট অগ্নিশক্তি বা ফায়ারপাওয়ার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে না এলে এ হামলা তাদের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারত।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উভয় দেশই নিঃশব্দে সমগ্র অঞ্চল জুড়ে একে অপরের স্বার্থকে লক্ষ্য করে চলেছে। ইরান হামাসকে সমর্থন করেছে এবং ইসরায়েলের শত্রু অন্যান্য আঞ্চলিক মিলিশিয়াদের অর্থায়ন ও অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে। এসব সংগঠনের মধ্যে বেশ কয়েকটি ৭ অক্টোবর হামাসের ভয়াবহ হামলার পর থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলায় লিপ্ত হয়েছে। একইভাবে ইসরায়েল নিয়মিত ইরানি প্রক্সিদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। পাশাপাশি ইরানি কর্মকর্তাদের ইরানের মাটিতে হত্যা করছে। উভয় দেশই তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বাণিজ্যিক জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। পাশাপাশি একে অপরের ওপর সাইবার হামলা চালিয়েছে এবং ইসরায়েল বারবার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে নাশকতা চালিয়েছে।
এখন সেই যুদ্ধ প্রকাশ্যে এবং সরাসরি এসেছে। এর কারণ ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে ইহুদিবাদী নেতাদের ভুল হিসাবনিকাশ।
ইসরায়েলি নেতারা বারবার বলছেন, ইরানের ওপর বৃহত্তর চাপ তেহরানকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে। যেমন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট জানুয়ারিতে বলেছিলেন, ‘ইরানের ওপর চাপ বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। এটি অন্যান্য ক্ষেত্রে আঞ্চলিক উত্তেজনা রোধ করতে পারে। তবে সেটা ভুল ছিল। দামেস্ক দূতাবাসে হামলা সরাসরি ইসরায়েলি সার্বভৌম ভূখণ্ডে প্রথম ইরানি হামলা ডেকে এনেছে।’
বিশ্লেষকরা বলেছেন, আগে ইসরায়েল ইরানের সিনিয়র কর্মকর্তাদের হত্যা করলেও দেশটি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতো না। এর ফলে ইরানের অবস্থানকে ভুল বুঝেছে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলি নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ভয় আছেন যে, ইরান একদিন ঠিকই ইসরায়েলে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করবে।
ইরানের বিশ্লেষক আলি ওয়ায়েজের মতে, ইরানের এবারের এমন প্রতিক্রিয়া জানানোর সিদ্ধান্ত আংশিকভাবে তেহরানের আগের নিষ্ক্রিয়তায় জনগণের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ।
ব্রাসেলসে অবস্থিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ভাইজ বলেছেন, ‘গত ১০ দিনে আমি ইরানি সরকারের ওপর যে মাত্রার চাপ দেখেছি, তা আগে কখনও দেখিনি। তা ছাড়া ইরানেরও হিজবুল্লাহর মতো প্রক্সিদের দেখানোর দরকার ছিল তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।’
ভাইজ বলেছেন, ‘দামেস্কে কূটনৈতিক স্থাপনায় ইসরায়েলের এ ধরনের নির্লজ্জ হামলার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ইরান যে ভয় পাচ্ছে না, তা প্রদর্শন করা তেহরানের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। অন্যথায় ইরানের আঞ্চলিক অংশীদারদের চোখে তেহরানের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হতো।’
ইসরায়েল নীতি বিষয়ক ইসরায়েলি বিশ্লেষক মাইকেল কপলো বলেছেন, ইসরায়েলকে হামলার প্রস্তুতির জন্য ইরানের এত সময় দেওয়ার কারণ হলো, তেহরান বড় ধরনের সংঘাত এড়াতে চেষ্টা করেছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশ্লেষক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ইসরায়েল গত ছয় মাসের মধ্যে দুটি বড় কৌশলগত ভুল করেছে। প্রথমটি হলো- অক্টোবরের আগে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এবং ভুলভাবে উপসংহারে পৌঁছেছিল যে, ইসরায়েলে হামলার করার ক্ষমতা হামাসের নেই। এরপর হামাস ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক হামলা চালায়। ইসরায়েল হামাসের ক্ষমতা এবং শক্তি সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে হামলা নিয়ে ইরান কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, ইসরায়েল স্পষ্টভাবে সে সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিল।
Leave a Reply